মহামারিতে গভীর আর্থিক সংকটে ইতালি

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এই দ্বিতীয় ধাপের আঘাত আরো প্রবল হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক হয়ে উঠেছে বিশ্বের নানা প্রান্তের দেশগুলো। ব্যতিক্রম নয় ইতালিও। 

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ইতালিও নিজেদের যথাসম্ভব সুরক্ষিত রাখতে আঁটসাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে। পুরো দেশে পুনরায় লকডাউন কর্মসূচি চালু করার পক্ষে দেশটির সরকার। তবে পুনরায় লকডাউনের পক্ষে মত নেই দেশটির সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের। তারা লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছে। 

এ অবস্থায় অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে বড় ধরনের প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিলেও তা দেশটির ঋণের বোঝা আরো ভারি করে তুলছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকাতে গভীর সংকটে পড়েছে ইতালি সরকার। 

চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে ইতালি সরকার নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করে। তখনই দেশটির ছোট ব্যবসায়ী ও রেস্টুরেন্ট মালিকদের নেতৃত্বে এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে যোগ দেন ক্যাটারিং ও পর্যটন খাতের সাথে যুক্ত মৌসুমি শ্রমিকরাও। তবে আন্দোলন এখন পর্যন্ত ব্যাপক আকার ধারণ করেনি, যার অন্যতম কারণ শ্রমিকদের জন্য সরকারের ঘোষিত নতুন অর্থনৈতিক প্রণোদনা। মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রেস্টুরেন্ট ও বারের মতো খাতগুলোতে সহায়তার জন্য ৫.৪ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন ডলার) প্রণোদনা ঘোষণা করে ইতালি সরকার। 

অথচ দেশটির বিভিন্ন স্থানে এখনো অসন্তোষ বিদ্যমান। নেপলস থেকে তুসক্যানি ইতালির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রেস্টুরেন্ট মালিকরা আন্দোলন করছেন। শিল্পকলা ও বিনোদনের সাথে যুক্ত কর্মীরাও আন্দোলনে অংশ নিতে রাস্তায় নামে। সবমিলিয়ে ইতালি সরকার এখন ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। একদিকে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা; অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি রক্ষা- এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা তাদের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছে। 

অনানুষ্ঠানিক কাজ ও বহু ধরনের ছোটখাটো ব্যবসার ওপর ইতালির অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। মহামারির কারণে উভয় খাতই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেকারত্বে নাজেহাল ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের অবস্থা আরো করুণ হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা ও অর্থনীতির ধস ঠেকাতে নানারকম প্রণোদনা পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে ইতালি সরকার। 

অরগানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) যেসব দেশ করোনাকালে জিডিপির হিসাবে সবচেয়ে বড় ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে তার মধ্যে ইতালিও রয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের মধ্যে অনেকের কাছেই সহায়তা পৌঁছাতে পারেনি ইতালি। অনেক পরিবারকেই প্রয়োজন না মিটিয়ে অথবা অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকতে হচ্ছে। মার্চে বেকার ভাতা ঘোষণা করা হলেও, নানারকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিলম্বিত হয়ে তা আরও বোঝা হয়ে উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, বেকার ভাতার অর্থ হাতে আসলেও তা লকডাউন পরিস্থিতিতে জীবনধারণ ব্যয় পুরোপুরি সম্পন্ন করার মতো নয়। এছাড়া ইতালিতে স্বল্পমেয়াদি কাজের প্রকল্পগুলো উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম অনুকম্পা পায়। 

অর্থনীতিবিদ আন্দ্রিয়া গারনেরোর মতে, এ পরিস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে- ইতালির কল্যাণ ব্যবস্থা সবচেয়ে দুর্বলদের পক্ষে নয়। এছাড়া করোনাভাইরাসের সময় কর্মীদের জন্য গৃহীত জব রিটেনশন (জেআর) স্কিম সরাসরি আয়ের সাথে সম্পৃক্ত। ফলে যেসব কর্মী নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা হিসেবে কাজ করে না, তাদের আয় এক কথায় কমে যায়। উল্লেখ্য, করোনাকালীন কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে ওইসিডিভুক্ত দেশগুলো যেসব কৌশল গ্রহণ করেছে, সেগুলোর মধ্যে জেআর অন্যতম। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত এ কর্মসূচির মাধ্যমে ওইসিডি অঞ্চলে ২০ মিলিয়ন কর্মসংস্থানে সহায়তা দেয়া সম্ভব হয়েছে। জেআর স্কিমের মাধ্যমে কর্মীদের নগদ অর্থ সরবরাহ করা হয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও তারা কর্মীদের ধরে রাখতে পারে।

গ্রীষ্মকাল ইতালির জন্য ভালো কেটেছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় গ্রীষ্মকালে এখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম ছিল; কিন্তু ডিসেম্বরে এসেই ইতালি সরকার দেশটির ২১ অঞ্চল এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের মধ্যে নয়টিকে উচ্চ ও মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংক্রমণের হার ও স্থানীয় স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে এ তালিকা করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে ইতালির সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লাম্বার্ডি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে ঝুঁকির মাত্রাভেদে লাল, কমলা অথবা হলুদ রং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইতালি সরকার। এই তালিকা নিয়েও স্থানীয় গভর্নররা সরকারের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও কর্মীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে।

নেপলসের সেলন মালিক গুইসেপ্পে এসপোসিতো এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। নিজেদের পুরো সক্ষমতা দিয়ে আমরা কাজ করতে পারছি না।’ 

উল্লেখ্য, নেপলস শহর ও এর অন্তর্ভুক্ত স্থান ক্যাম্পানিয়া উচ্চ মাঝারি ঝুঁকি ক্যাটাগরিতে রয়েছে। দোকানের আয় কতটা কমে গেছে তা বোঝাতে এসপোসিতো বলেন, ‘সাধারণত সেলুন থেকে বছরে ৫০ হাজার ডলার টার্নওভার আসে; কিন্তু চলমান সংকটের কারণে তা ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। অথচ ইতালিতে ছোট ব্যবসা পরিচালনার খরচ অনেক। অন্ধকার শেষে আলোর দেখা পাওয়া এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।’

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তা জেঁকে বসেছিল। মহামারির কারণে এ সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। যেমন- সিসিলি ও ক্যাম্পানিয়ার দক্ষিণের অঞ্চলের প্রচুর মানুষ দারিদ্রের ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৮ সালেও যেখানে ৫০ শতাংশ মানুষ কল্যাণভাতা পেতেন, সেখানে তা এখন ২৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

নেপলসের বাসিন্দা ৩৫ বছর বয়সী গ্রাফিকস ডিজাইনার সালভাদর কারসো বলেন, মহামারি ঘনীভূত হওয়ার আগে থেকেই অনিশ্চয়তা অনুভব করছেন তিনি। নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন কারসো ও মহামারি আঘাত হানার পরেও পারিশ্রমিক পেয়েছেন। একটি কোম্পানির সাথে তার নামমাত্র ঠিকাদার চুক্তি রয়েছে, যা ১৫ দিনের নোটিশেই শেষ করে দেয়া হতে পারে। কারসো বলেন, ‘আমি কোনো কল্যাণ ভাতা পাবো না। এমনকি আয়ের কোনো বিকল্প উৎসও নেই আমার।’

ব্রাসেলসভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুজেলের সিনিয়র ফেলো ফ্রান্সিসকো পাপাদিয়া জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইতালির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- দেশটির অর্থনীতি ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর বর্তমান কঠিন সময়ে এ দুটি ব্যবসা খাতে সহায়তা করা সবচেয়ে কঠিন।

ইতালীয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ইতালির জিডিপির ১১ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাত নির্ভর। এর মধ্যে সেবাখাতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, যা মহামারিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ওপর সিংহভাগ নির্ভরশীল পরিবহন ও পর্যটন খাত দেশটির অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রায় ৪০ শতাংশ (আর্থিক হিসাবে ১৯২ বিলিয়ন ইউরো) দখল করে আছে। অথচ গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সামগ্রিক বেসরকারি খাতের ১১ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম।

বেসরকারি সংস্থা কারিতাসে দারিদ্র্যতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতালিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ‘নতুন দারিদ্র’ সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হচ্ছে। চলতি বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর এ সময় আংশিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষণ হলেও এই দাতব্য সংস্থাটি থেকে সেবা গ্রহীতার হার গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে নারী, তরুণদের সংখ্যা অনেক। শ্রমবাজারে আগে থেকে পিছিয়ে রয়েছে নারীরা, মহামারি তাদের কর্মজীবনকে আরো হুমকির মধ্যে ফেলেছে। আর তরুণরা অনিশ্চিত অথবা অস্থায়ী চুক্তিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশটিতে আয় বৈষম্য ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। ইইউভুক্ত চরম আয় বৈষম্য থাকা দেশগুলোর মধ্যে ইতালি অন্যতম। আয় বৈষম্য পরিমাপক সূচক গিনি ইনডেক্সে সর্বশেষ ২০১৭ সালে ইতালির অবস্থান ছিলো ২৪তম। 

কারিতাসের এই প্রতিবেদনটির লেখক ফ্রেডরিকা দে লাউসো এ প্রসঙ্গে ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘দারিদ্র্যের চিত্র খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, যা সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। এক অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের নতুন ঢেউ আসছে।’ উল্লেখ্য, গত বছর ইতালিতে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ। মহামারি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে অনানুষ্ঠানিক কাজ দেশটিতে কতটা ছড়িয়ে পড়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার মাত্র এক বছর আগে ইতালিতে ‘সিটিজেনস ইনকাম’ নামে একটি স্কিম চালু করা হয়। ইতালিতে কমপক্ষে ১০ বছর বসবাস করছেন এমন চাকরি প্রার্থীদের একটি ন্যূনতম আয়ের গ্যারান্টি দেয়াই ছিল এ স্কিমের উদ্দেশ্য। আর চলতি বছর এই স্কিমটি মহামারিতে সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

বিভিন্ন প্রণোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করা হলেও অন্যদিক দিয়ে ঝুঁকি বাড়ছে ইতালি সরকারের। দেশটিতে ঋণের অংক হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। ঋণের দিক থেকে ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গ্রিসের পরেই ইতালির অবস্থান। বর্তমানের সংকট অব্যাহত থাকলে ইতালির সার্বিক ঋণের অংক জিডিপির ১৫৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

তবে কিছুটা হলেও স্বস্তির বিষয় হলো- ইতালির ঋণ ফুলে ফেঁপে উঠলেও সুদের হার কম থাকার কারণে তাদের ওপর চাপ কিছুটা কম। এছাড়া ইইউর কঠিন বাজেট নীতিমালা স্থগিত থাকার কারণে ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সের মতো অতি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আরো ঋণ নিতে পারছে। ইতালি ইইউ থেকে ২০৯ বিলিয়ন ইউরো (২৫০ বিলিয়ন ডলার) পুনরুদ্ধার তহবিল হিসেবে নগদ অর্থ পেতে যাচ্ছে। দেশটি আশা করছে কম সুদে ঋণ ও এই সহায়তার মাধ্যমে তারা ঘুরে দাঁড়াবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতালি যদি এই অর্থ ভালোভাবে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে দেশটি তাদের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //